জামালপুর সদর উপজেলার পটভূমি

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার উত্তরাঞ্চলের মাঝখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ পরিবেশে জামালপুর জেলার অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র যমুনা বিধেৌত পলিমাটির এক লালন ভূমি জামালপুর। ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর হযরত শাহ জামাল (রা:) এর স্মৃতি বিজড়িত জামালপুর মহকুমা থেকে জামালপুর জেলা হিসেবে উন্নিত হয়। জেলা সৃষ্টির সময় শেরপুর মহকুমার ৫টি এবং জামালপুর মহকুমার ৬টি থানা নিয়ে এ জেলা গঠিত হয়। জামালপুর সদর উপজেলা জেলা হেডকোয়াটারের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। জামালপুর সদর উপজেলার আয়তন ৪৮৯.৫৬ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২০১১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী ৬,১৫,০৭২জন(প্রায়)।

জামালপুর নামকরণ নিয়ে অনেক লোকগাঁথা এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য জড়িয়ে নানামুখী কাহিনী প্রচলিত রয়েছে এবং নানা ধরণের ইতিহাসও রয়েছে। তবে নানা মতবাদ থাকা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে সকলেই প্রায় এক ও অভিন্ন মত পোষণ করেন। উল্লেখ্য যে, এ জনপদের পূর্বনাম ছিল সিংহজানী। ১৯৫৪ সালে মুদ্রিত ‘‘জামালপুরের গণ ইতিবৃত্ত’’বইয়ের লেখক আলহাজ্ব গোলাম মোহাম্মদ হযরত শাহ্ জামাল (রঃ) সর্ম্পকে তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘‘ভারত সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালে আরবের ইয়েমেন প্রদেশ হতে দেশভ্রমন উপলক্ষে হযরত শায়েখ জামাল নামক একজন কামেল এই উপমহাদেশে আগমন করেন এবং ইহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ তীরে সিংহজানী বর্তমান জামালপুর নামক স্থানে তাহার খানকা স্থাপন করেন। তাহার কৃচ্ছসাধনা ও অলৌকিক ক্ষমতার কথা অচিরেই দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছিলে মহামান্য ভারত সম্রাট তাহার খানকা শরীফের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য বর্তমান জামালপুরের অন্তর্গত কয়েকটি পরগণা ‘‘পীরপাল’’ প্রদান পূর্বক পীর সাহেবের নিকট ইহার সনদ পাঠাইয়া দেন। এভাবেই হযরত শাহ্ জামাল (রঃ) এর ধর্মপ্রচার প্রসারিত হতে থাকে এবং তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এভাবেই জামালপুর নামটি এ অঞ্চলের মানুষের মনের মধ্যে গ্রথিত হতে থাকে এবং জামালপুর নামটি সারা ভারত বর্ষে প্রচারিত হতে থাকে। পরবর্তীতে সরকারী ভাবে এ জন পদের নাম জামালপুর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

জামালপুর ভূপ্রকৃতি জলাবায়ুঃ

জামালপুর সদর উপজেলা ২৪ .৪২ উত্তর এবং ৮৯০ ৫২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।  অত্র উপজেলার মেৌসুমি জলবায়ু উষ্ণ আর্দ্র ও নাতিশীতোষ্ণ। শীত ও গরম মধ্যম ধরনের; চরমাভাবাপন্ন নয়। শীতকালে প্রচুর কুয়াশা হয়। নভেম্বর ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো কোনো বছর বৃষ্টিপাত হয়। এই সময় তাপমাত্রা ১৫ডিগ্রি-২৭ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা ২৫ডিগ্রি-৩০ডিগ্রি সে। গড় বৃষ্টিপাহ ১৯২ডিগ্রি.৫৫ডিগ্রি মি.। মূলত এটেঁল, বেলে-দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি সমৃদ্ধ এলাকা জামালপুর সদর উপজেলা। তবে প্রচুর পরিমাণে ফসল ফলে। এখানকার ৭০% এলাকা সমতল, বাকি অংশ অসমতল ও বনভূমি দ্বারা গঠিত। এই এলাকার সমতল ভূমি পলিসিক্ত ও উর্বর। বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৮৭৫ মি.লি. থেকে ১৯৫০ মি.লি। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ২৩ডিগ্রি থেকে ৩০ডিগ্রি সেলসিয়াস।

জামালপুর নদী প্রকৃতিঃ

নদীঃ      জামালপুর সদর উপজেলার উপর দিয়ে দুটি নদী বয়ে গেছে। একটি ব্রহ্মপুত্র নদ অপরটি ঝিনাই নদী।  ব্রহ্মপুত্র নদটি তিববতের মানস সরোবর থেকে সাংপো নামে উৎপন্ন হয়ে ভারতের অরূণাচল প্রদেশের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র (ব্রহ্মার সন্তান) নামে প্রবাহিত হয়েছে। প্রবাহস্থানে ৫টি প্রধান উপনদী থেকে ব্রহ্মপুত্র পানি সংগ্রহ করেছে যাদের মধ্যে ডিহঙ্গ এবং লুহিত প্রখ্যাত। এ ধারা পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার মাজাহরালীতে দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখান থেকেই নদীর নাম হয়েছে ব্রহ্ম-যমুনা। অধিকতর ক্ষেত্রে যমুনা নামেই পরিচিত। এধারা দক্ষিণে ২৭৭ কিঃ মিঃ প্রবাহিত হয়ে আরিচার কাছে আলেকদিয়ায় গঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এ মিলিত ধারা দক্ষিণ পূর্ব দিকে ২১২ কিঃমিঃ প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের নিকট মেঘনায় পতিত হয়েছে। অপর দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা থেকে ঝিনাই নদীর উৎপত্তি হয়েছে।

River

প্রকৃতিঃ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। চারিদিকে সবুজের সমারোহ এবং শোভা এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সব ধরনের ফসলই এখানে উৎপন্ন হয়। চরাঞ্চলে  শাক-সবজি বিশেষতঃ টমোটোসহ বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপন্ন হয়। অপর দিকে পাহাড়ী অঞ্চলে ফলমূল ও উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপন্ন হয়। জামালপুর সদর উপজেলাটি দেওয়ানগঞ্জ সুগার মিল এলাকার আওতার্ভৃূক্ত হওয়ায় এখানে প্রচুর আখ উৎপন্ন হয়। এখানকার মাটি যে কোন ফসলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

জনগোষ্টীর নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ

জামালপুর সদর উপজেলায় বাগড়া, হায়েতপুর, বিষ্ণপুর, শ্রীপুর কুমারিয়া, তুলশীপুর, রামনগর, চাঁদপুর, মাইনপুর, তারাগঞ্জ, দড়িপাড়া, ডেংগার ঘড়, বেড়াপাথালিয়া, রণরামপুর, শাহবাজপুর ও মির্জাপুরে নৃ-তাত্বিক জনগোষ্টির বাস রয়েছে। এরা গারো ও কুচ সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের জীবন ধারা সত্যই বড় বৈচিত্রময়। আমাদের বাঙালী সমাজের জীবন ধারার চেয়ে এদের জীবন যাত্রা প্রণালী ভিন্ন ধরনের। এরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। মেয়েরা ক্ষেত খামার সহ পরিবারের যাবতীয় কাজ করে থাকে। তবে পুরুষরাও ক্ষেত খামার সহ পরিবারের অন্যান্য কাজ করে। এদের মধ্যে প্রায় অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই শিক্ষিত।

এদের প্রধান কর্ম বাঁশ বেত, মাছ ধরা, দিন মজুরী, চাকুরী, সেলাই, বৃক্ষরোপন, হাঁস-মুরগী, ছাগল ও গরু পালন। এদের বসত বাটী ব্যতীত আবাদী কোন জমি নেই বললেই চলে। এরা অন্যের জমি বর্গা চাষ করে। এদের খাবারের মধ্যে রয়েছে ভাত, মাছ, মিষ্টি আলু, শিকড়ের আলু, থামা আজং, গরু, ছাগল, খাসী, শুকুর, কচ্ছপ, কুইচ্চা, নাখাম, চু, কাকতোয়া ইত্যাদি।

মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীকে নিজ বাড়ীতে নিয়ে আসে। এদের উত্তরাধীকারী হলো মেয়ে। এদের সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন এবং ইংরেজী নববর্ষ। সামাজিক উৎসবের মধ্যে ওয়ানগালা-আর্শ্বিন মাসে পালিত হয়। ঐ দিন নাচ গানসহ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। অন্যান্য উৎসবের মধ্যে রয়েছে চৈত্রসংক্রান্তীমেলা।

এরা অবসর সময় খুব কমই পায়। তবে যে টুকু অবসর পায় সেসময় তারা জাল, বুনন, বেতের কাজ, গান বাজনা, ও রেডিও টি.ভি দেখে থাকে।

মোট উপজাতির সংখ্যা                             :          ৫৩৮৭ জন।

পুরুষ                                             :           ২৫৩৯ জন।

মহিলা                                            :           ২৮৪৮ জন।

পরিবার সংখ্যা                                     :           ১৯৮৫টি।

খানার সংখ্যা                                      :           ১৯৮৫ টি।

শিক্ষার হার                                        :           ৯৪.৮১%