জামালপুর জেলার সুপ্রাচীন ইতিহাস
শাহ জামাল নামক এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তি এই অঞ্চরে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন। এর থেকেই এই শহরের নাম করা হয়েছে জামালপুর। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, জিঞ্জিরাম, সুবর্ণখালী, বংশ নদী তীরবর্তী উঁচুভূমি ও জঙ্গলাকীর্ণ জামালপুরে কবে থেকে লোকালয় গড়ে উঠে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, ৮’শ বছর পূর্ব থেকে জঙ্গলাকীর্ণ এই ভূ-খন্ডে জনবসতি শুরু হয়। উত্তাল যমুনা, ব্রহ্মপুত্র হয়ে জঙ্গলাকীর্ণ এই ভূ-খন্ডের বুক চিরে বয়ে যাওয়া অধূনালুপ্ত বংশ নদী হয়ে ব্যবসায়ীদের বিশাল সব বজরা নৌকা যাতায়াত করতো উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গে। যাতায়াতের পথে ব্যবসায়ী সওদাগররা জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকার নদীর তীরে বজরা থামিয়ে বিশ্রাম নিতো। বংশ নদী তীরবর্তী ব্যবসায়ী সওদাগরদের বিশ্রামস্থলটিতে একসময় ছোট্ট একটি “গঞ্জ” গড়ে উঠে। এভাবে ক্রমশ: এই অঞ্চলটি “গঞ্জের হাট” নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ব্যবসায়ী সওদাগরদের বিশ্রামস্থলটি এখনো শহরের মাঝখানে “রাণীগঞ্জ” বাজার নামে অতীত স্মৃতির জানান দেয়।
মূলত গঞ্জের হাটকে কেন্দ্র করে সে সময় জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। ধারণা করা হয় যে, প্রাচীন বঙ্গের গৌড়ের সেন বংশের রাজত্বকালে (১১০০-১২০৩ খ্রী:) হিন্দুদের মধ্যে যখন কলীন প্রথার প্রচলন হয়, তখন এই এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠে। এ সময় গঞ্জের হাটের কাছের একটি এলাকায় শিবমিন্দর স্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে কাছাকাছি এলাকায় স্থাপিত হয় দয়াময়ী মন্দির। একসময় শিবমন্দিরকে ঘিরে একশ্রেণীর হিন্দু সন্ন্যাসীদের আনাগোনা শুরু হয় এই অঞ্চলে। পরে দূরদেশ থেকে আগত এই সব হিন্দু সন্ন্যাসীরা আস্তানা গড়ে এই শিবমন্দিরে। হিন্দু সন্ন্যাসীদের আগমনে এবং তাদের পদচারণায় অঞ্চলটি “গঞ্জের হাট” থেকে “সন্ন্যাসীগঞ্জ” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ক্রমান্বয়ে হিন্দু জমিদারদের উদ্ভব হলে সন্ন্যাসীগঞ্জকে মৌজা তৈরি করে এর নাম রাখেন “সিংহজানী”। এই সিংহজানী মৌজা থেকেই আজকের জামালপুর জেলা। জেলা শহরের দুইটি বিদ্যালয়ের নামের সাথে সিংহজানী নামটি আজও সমুন্নত।
জামালপুর বর্তমানে ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জেলা। নদীভাঙনে যার আকার ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জেলাটি। কিন্তু অতীত নানা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এ জেলার সৃষ্টি আর নামকরণের ক্ষেত্রে রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। দিল্লীর তৃতীয় মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৪২-১৬০৫ খ্রী:) ইয়েমেন থেকে ইসলামধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শাহ্ জামাল সিংহজানী মৌজায় আগমন করেন। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ক্ষরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নিজ আস্তানা স্থাপন করেন। সে সময় তার অলৌকিক ক্ষমতার কথা দিল্লী পৌঁছলে সম্রাট আকবর তাকে খানকাহ্ শরীফ বা আস্তানার ব্যয় নির্বাহের জন্য সিংহজানীর অন্তর্গত কয়েকটি পরগণা “পীরপাল” হিসেবে প্রদান করে তার কাছে সনদ পাঠালেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ইসলামের পতাকাবাহী এবং একত্মবাদের একনিষ্ঠ প্রচারক শাহ্ জামাল-এর পূণ্যাত্মার প্রতি স্মরণার্থে পরবর্তীতে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় “জামালপুর”।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, দিল্লির সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫) হযরত শাহ জামাল (রহ.) নামে একজন ধর্মপ্রচারক ইয়েমেন থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ২০০ জন অনুসারী নিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। পরবর্তীতে ধর্মীয় নেতা হিসাবে তিনি দ্রুত প্রাধান্য বিস্তার লাভ করেন। ধারণা করা হয়, শাহ জামাল-এর নামানুসারে এই শহরের নামকরণ হয় জামালপুর।
জামালপুর ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে প্রথম মহকুমা হিসেবে ১৮৪৫ সালে মর্যাদা লাভ করে। মহকুমা সৃষ্টি হওয়ার ১৩৩ বছর পরে ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জেলার মর্যাদা পায়। জামালপুর জেলা গঠনের আন্দোলন মূলত: বঙ্গভঙ্গের পরে ১৯১২ সালেই সূচীত হয়। ১৯১২ সালে লর্ড কার্জন জামালপুরকে জেলা করার ঘোষণা দেন। ১৯১৯ সালের দিকে ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ধনবাড়ীকে জেলা সদর করে জামালপুর ও টাঙ্গাইলকে নিয়ে একটি জেলা করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু এতে জামালপুর ও টাঙ্গাইলবাসী কোন পক্ষই সমর্থন করেনি। ১৯০৮ সালে শেরে-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক জামালপুর এর মহুকুমা প্রশাসক থাকার সময় জামালপুরকে জেলা করার দাবী আরো বেগবান হয়ে উঠে। জামালপুরকে জেলা হেডকোয়ার্টার করার জন্য ১৯১৭ সালে জামালপুর পৌর এলাকায় ২৩৫ একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করে। ১৯২০ সালে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানার কয়েকটি গ্রাম সরিষাবাড়ী থানার সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের উদ্যোগে জামালপুরকে জেলা করার দাবী সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জামালপুর না টাঙ্গাইল কোথায় জেলা সদর হবে এ নিয়ে তৎকালীন বৃটিশ সরকারও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। এ সময়ে বন্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইতাদি কারণে জামালপুর জেলার বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়ে। ঐ সময়ে কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের বহু প্রভাবশালী নেতা থাকলেও নিজেদের কোন্দলের কারণে তারা জামালপুর জেলার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি, যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে ধরতে পারেননি জামালপুর জেলা গঠনের প্রয়োজনীয়তা। যে কারণে জামালপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হতে প্রায় ১৩৩ বছর সময় লেগেছে।
১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর জামালপুর হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই জামালপুরকে জেলা করার দাবী আবারো বেগবান হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৫ সালে জামালপুরকে জেলা করার প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৭৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর জামালপুর বাসীর জন্য একটি আনন্দের দিন। কারণ এ দিনে জামালপুরকে স্বাধীন বাংলাদেশের ২০তম জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
জামালপুর জেলা সৃষ্টির প্রতিষ্ঠা লগ্নে যে সকল সরকারী কর্মকর্তা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনাব কেরামত আলী, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জনাব খানে আলম খান, ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক জনাব বদিউর রহমান, জামালপুর মহকুমা প্রশাসক জনাব আব্দুর রশিদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র
↑ “Jamalpur District Information – Amardesh Online”।
↑ “জেলার পটভূমি – Jamalpur District – জামালপুর জেলা”।
https://m.facebook.com/alokitojamalpurbd@ উইকিপিডিয়া।